বিছানায় বসে বসে রুমটা ভালো করে চারিদিকে তাকিয়ে দেখছি। নামাজ শেষ করে আমায় বসে থাকতে বলে উনি কোথায় যেনো গেছেন। তাই বসে বসে পুরো রুমটায় চোখ বুলাচ্ছি।
হঠাৎ আমার চোখ পরলো রুমের দক্ষিন দিকের জানালার দিকে। জানালা অনেক সুন্দর রাজকীয় কারুকাজ করা। কেনো জানিনা আমার খুব ইচ্ছা করছে জানালাটা খুলে একটু বাইরে দেখতে। ইচ্ছাটা আর মনের মাঝে সীমাবদ্ধ না রেখে জানালার কাছে চলেই গেলাম। জানালা টা কাছ থেকে দেখতে যেনো আরো বেশি আকর্ষণীয় লাগছে। আমি যখনি জানালাটা খুলতে যাবো তখনি কোথা থেকে যেনো উনি এসে আমার হাতটা খপ করে ধরে ফেললেন। তারপর হালকা রাগি গলায় বললেন
-- জানালার কাছে কেনো এসেছো চাঁদ। আমি তোমায় বলেছি না যে বিছানায় বসে থাকো আমি আসছি? তাহলে এখানে কেনো এসেছো?
ওনার কথা শুনে আমি মাথা নিচু করে আস্তে করে বললাম
-- আসলে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছিলো জানালার বাইরে কেমন। আর জানালাটা অনেক সুন্দর তাই,,,,,
এতটুকু বলতেই উনি আমার মুখের কথা কেরে নিয়ে বলে উঠলেন
-- যতই মনে চাক না কেনো, কখনো ভুল করেও সন্ধার পর জানালা খুলবে না। নিজের বাবার বাসায় যেমন থেকেছো সেই ভাবেই থাকবে বুঝলে?
-- আপনি কি করে জানলেন যে আমার ঐ বাসাতেও জানালা খোলা নিষেধ ছিলো সন্ধার পর?(অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম)
-- আমি সব জানি, এখন চলো বিছানায়।
ওনার কথা শুনে আমি ভয়ে শুকনো ঢোক গিলে মনে মনে বললাম
-- বিছানায় যাবো মানে, কি বলতে চাইছেন উনি?
-- আরে চাঁদ আমি বলতে চাইছি অনেক রাত হয়েছে তাই বিছানায় চলো ঘুমাবে। সকালে আবার নামাজ পড়তে উঠতে হবে তো নাকি?
ওনার কথা শুনে একটু শান্তি পেলাম। তারপর বিছানার দিকে পা বাড়ালাম। তবে মনে মনে একটা প্রশ্ন থেকেই গেলো। উনি কি করে আমার মনের কথা বুঝে যাচ্ছে বার বার?
প্রশ্নটাকে দুরে রেখে বিছানার ওপর গিয়ে বসে পড়লাম। উনি আমার সামনে এসে বসে আমার দিকে না তাকিয়ে বলে উঠলেন
-- মন খারাপ করো না চাঁদ, তোমার আব্বু যখন তোমার সব দ্বায়ীত্ব আমার হাতে তুলে দিয়েছেন তখন আমি যা করবো সব তোমার ভালোর জন্যেই করবো মনে রেখো সব সময়। আমি থাকি আর না থাকি, কখনোই সন্ধার পর জানালা খুলবে না তুমি। আমার এই কথাটা আশা করি তুমি মনে রাখবে।
ওনার কথার উত্তরে আমি কিছুই বললাম না। মাথা নিচু করে চুপ করে বসে আছি আমি। তখনি উনি আমার ডান হাতটা ওনার ডান হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো। আচমকা এভাবে হাত ধরায় কিছুটা কেপে উঠলাম আমি। আমাকে কেপে উঠতে দেখে উনি আবারও ওনার সেই মারাত্মক মুচকি হাসিটা দিলেন। তারপর আমার হাতে একটা অনেক সুন্দর আর অদ্ভুত ধরনের বালা পড়িয়ে দিয়ে বললেন
-- বাসর ঘরে সব স্বামীই তার স্ত্রীকে কিছু না কিছু উপহার দেয়। তবে আমি তোমায় এই বালাটা শুধু উপহার হিসাবেই দিলাম না। বরং এই বালাটার উসিলায় আল্লাহ তোমায় সকল বিপদ থেকে রক্ষা করবেন। ভুল করেও এই বালাটা কখনো নিজের কাছ ছাড়া করবে না, এটা তোমার স্বামীর আদেশ চাঁদ।
ওনার কথা শুনে আমি কিছুটা অবাক হয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম
-- আপনার কথা ঠিক বুঝলাম না আমি। আমার আবার কিসের বিপদ আপদ হবে যে এই বালা আমায় রক্ষা করবে। আর এমন সাধারন একটা বালায় কিই বা আছে?
আমার কথা শুনে উনি মুচকি হেসে বললেন
-- শুয়ে পরো চাঁদ অনেক রাত হয়ে গেছে। সকালে উঠতে হবে।
ওনার কথায় কিছুটা বিরক্ত হলাম আমি। আমার কোনো কথার সঠিক উত্তর উনি দিচ্ছেন না। শুধু এড়িয়ে যাচ্ছেন, কেমন লোক রে বাবা। ইচ্ছা করছে ওনার সাথে ঝগড়া বাধাই। কিন্তু বাসর রাতে বরের সাথে ঝগড়া করলে সবাই বলবে কি আর উনিই বা কি ভাববেন।
এসব কথা চিন্তা করে শুয়ে পড়লাম। আমার উল্টো পাশে উনিও শুয়ে পড়লেন। তবে আমার থেকে বেশ কিছুটা দুরুত্ব বজায় রেখে।
অনেকক্ষণ হলো শুয়ে পড়েছি কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছে না আমার। ইয়াসীনের কথা খুব বেশি মনে পড়ছে। ওর সাথের ঝগড়াগুলোকে খুব বেশি মিস করছি আমি। ইয়াসীনের কথা ভাবতে ভাবতে চোখ থেকে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পরলো। তখনি উনি আমায় ডেকে বললেন
-- চাঁদ চলো না আজকে রাতে দুজন গল্প করে কাটাই, ঘুম আসছে না কিছুতেই। চাইলে ঝগড়াও করতে পারো আমার সাথে। আমি কিন্ত খুব একটা মন্দ ঝগড়া করি না।
ওনার কথা শুনে অবাক হয়ে লাফিয়ে উঠে বসলাম আমি।তারপর ওনার দিকে তাকিয়ে আমি কিছু বলবো তার আগেই উনি বলে উঠলেন
-- ওহ তুমি তো এখনো আমার সম্পর্কে কিছুই জানোনা তাই না চাঁদ। আচ্ছা আমি আগে আমার ব্যাপারে তোমায় সব ক্লিয়ার করে বলি তারপর না হয় গল্প বা ঝগড়া শুরু করবো কেমন?
ওনার কথা শুনে আমি কিছু বলছি না বরং ড্যাব ড্যাব করে ওনার দিকে তাকিয়ে আছি। কথা বলার সময় ওনার চুলগুলো হালকা নড়ছে, হালকা গোলাপি রঙের ঠোট দুটো কি সুন্দর করে কথা বলছে। দাড়িগুলোও ওনার কথা বলার সাথে নড়ে চলেছে সমান তালে। ইশশ এত সুন্দর কেনো উনি। ছেলেরা বুঝি এতটাও সুন্দর হয়। ইচ্ছা করছে ওনার গালটা টিপে দিয়ে বলি তুমি এতো কিউট কেনো গো। আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে উনি আমার দিক থেকে চোখ সরিয়ে বলে উঠলেন
-- বলছি যে চাঁদ তুমি যদি এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকো তাহলে আমি তোমায় নিজের সম্পর্কে বলবো কি করে। মরে যাবো তো তোমার চাহনিতে। প্লিজ আমার দিক থেকে চোখটা সরাও আর মনে মনে ওসব বলো না।(করুন গলায়)
ওনার কথা শুনে দ্রুতো ওনার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম আমি। ছি ছি কি লজ্জা কি লজ্জা, আমি এতটা নির্লজ্জ হলাম কবে থেকে। আর এই লোকটাই বা কেমন শুধু আমায় লজ্জা দিয়ে চলেছে। বলি আপনাকে এত সুন্দর হতে কে বলেছে শুনি। আমার খালি তাকিয়ে থাকতেই মন চায়।
আমি মাথা নিচু করে বসে আছি, লজ্জায় মাথা তুলে তাকানোর ক্ষমতা আর আমার নেই। জীবনের প্রথম কোনো অচেনা অজানা পুরুষের সাথে এক রুমে একা আছি। অথচো আমার ভয় বা লজ্জা হওয়ার বদলে আমি ওনাকে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছি। ছি ছি লোকে জানলে কি বলবে আমায়। ভাবতেই লজ্জায় মরে যেতে মন চাইছে।
আমি যখন এসব ভাবনায় ব্যাস্ত তখন উনি বলে উঠলো
-- হয়েছে হয়েছে এত লজ্জা পেতে হবেনা। লজ্জা পেলে তোমায় যে পেত্নীর মতো লাগে তাকি তুমি জানো চাঁদ?
ওনার কথা শুনে খুব রাগ হলো আমার। ইশশ নিজে সুন্দর বলে কি আমায় পেত্নী বলবে নাকি? আমিও তো কম সুন্দরী নই। পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি লম্বা, গায়ের রঙ ওনার মতোই ফর্সা তবে রাগলে বা লজ্জা পেলে গালদুটো লাল হয়ে যায় আমার। চোখ দুটো বেশি বড় না হলেও অনেক বেশি মায়াবি, চোখের জন্যে আম্মু আমায় মায়াবিনী বলে ডাকতেন, চুলগুলো কোমড় পর্যন্ত লম্বা, গোলাপি ঠোট গুলুমুলু গোলগাল চেহারার অধিকারী আমি। ছোট বেলায় যখন স্কুলে পড়তাম তখন আমার সব বান্ধবীরা আমায় বলতো ওরা ছেলে হলে আমায় নিয়ে ভেগে যেতো। সবার মুখেই আমি সব সময় নিজের রুপের প্রশংসাই শুনেছি। আর এই লোকটা কিনা আমায় পেত্নী বললো। কত্ত বড় সাহস এই বজ্জাতটার। ইচ্ছা করছে চিমটি দিয়ে দিয়ে ব্যাটারে আমাকে পেত্নী বলে ডাকার মজা বুঝাই।
হঠাৎ ওনার অট্টহাসি শুনে ধ্যান ভাঙলো আমার। কেনো জানিনা উনি হো হো করে হেসেই চলেছে। ইশশ কি কিউট সেই হাসি। আমার চোখদুটো আবারও তার দিকে আটকে গেছে। রাগ গুলোও কোথায় যেনো হাওয়া হয়ে গেছে।
বেশ কিছুক্ষণ হাসার পর উনি হাসি থামিয়ে বললো
-- চাঁদ তুমি কি জানো যে তুমি একটি পাগলী। আর তোমার এই পাগলামো গুলো যে আমায় কিভাবে ঘায়েল করছে তোমার কোনো ধারনাই নেই। প্লিজ একটু চুপ করো নইলে আমি তো এবার সত্যিই পাগল হয়ে যাবো।
ওনার কথা শুনে আমি মুখটাকে বাংলার পাঁচ বানিয়ে বললাম
-- আমি আবার কখন কি বললাম, আমি তো চুপ করেই আছি?
আমার কথা শুনে উনি মুচকি হেসে বললেন
-- নাহ কিছু না চাঁদ। আচ্ছা শুনো তবে আমার পরিচয়। আমার নাম শামীম হাসান, আর যে বৃদ্ধ মহিলা তোমায় বরন করলেন উনি আমার দাদিমা, মানে তোমার দাদিশাশুড়ি, উনি আমায় ভালবেসে খোকা বলে ডাকে। আমার দাদিমা ছাড়া পৃথিবীতে আর আপন কেউ নেই। আর এখন তুমি আছো আমার আরেক পৃথিবী। তোমার আর তোমার পরিবারের ব্যাপারে আমি সব জানি। তোমার আব্বুও মানে আমার শশুড়মশাইও আমায় চেনেন। তাই তোমার সব দ্বায়ীত্ব উনি আমার হাতে তুলে দিয়েছেন। আর তোমাকে সব রকম বিপদ থেকে রক্ষা করার দ্বায়ীত্বও আমার।
ওনার কথা শুনে আমি অবাক হয়ে বললাম
-- আমার আবার কিসের বিপদ আছে যে আব্বু আপনাকে আমার দ্বায়ীত্ব দিয়েছেন?
আমার কথা শুনে উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন
-- নাহ এমনিই বলছিলাম। আসলে স্ত্রীর সব দ্বায়ীত্ব তো তার স্বামীকেই নিতে হয় তাইনা?
-- জ্বি,,
-- আচ্ছা তোমাকে আরো একটা কথা বলতে চাই আমি চাঁদ। কিন্তু কথাটা ঠিক কি ভাবে বলবো বুঝে উঠতে পাড়ছি না।
ওনার কথা শুনে আমি মাথা নিচু করে আস্তে বললাম
-- বলুন আমি শুনছি সমস্যা নেই।
আমার কথা শুনে উনি আমার ডান হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলেন। ওনার এমন কান্ডে আমি অবাক চোখে ওনার দিকে তাকালাম। উনি আমার দিকে একবার তাকিয়ে তারপর নিচের দিকে চোখ ফিরিয়ে বলতে লাগলেন
-- চাঁদ তুমি আমার স্ত্রী আর আমি তোমার স্বামী। কিন্তু কোনো একটা বিশেষ কারনে আমি তোমাকে পরিপুর্ন স্ত্রীর অধিকার দিতে পারবো না। আমরা একসাথে এক ঘরে থাকবো ঠিকি কিন্তু সব স্বামী স্ত্রীর মতো আমাদের মাঝে সম্পর্ক থাকবে না।
তবে আমি তোমায় কথা দিচ্ছি যখন সময় আসবে তখন তোমায় আমি পুরোপুরি নিজের করে নিবো। ততদিন আমি তোমার কাছে সময় চাই চাঁদ। আমরা কি ততদিন বন্ধু হয়ে থাকতে পারিনা?
ওনার কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। তবে মনে মনে রাগ দেখিয়ে বলে উঠলাম
-- ইশশ ওনার কথা বলার ঢং দেখো। এমন করে বলছেন যেনো আমি ওনার সাথে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক করতে মরে যাচ্ছি। আরে আপনি আমার থেকে দশ মাইল দুরে থাকলে আমি বেচে যাই। আমি তো খুশি হলাম এটা জেনে হুহহ।
উনি আমার হাত ছেড়ে দিয়ে মুচকি হেসে বললো
-- ধন্যবাদ চাঁদ, আমি জানতাম তুমি আমার কথা রাখবে।
ওনার কথা শুনে আমি অবাক হয়ে ওনার দিকে তাকালাম। আরে আমি তো এখনো ওনাকে কিছুই বলিনি। তাহলে উনি জানলো কি করে?
রাতে আরো অনেক গল্প করলাম দুজন। গল্প করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি নিজেও জানিনা।
সকালে কারো মধুর কন্ঠে কোরআন তেলাওয়াত শুনে ঘুম ভেঙে গেলো আমার। ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে দেখি হাসান কোরআন পড়ছে। ইশশ কি মিষ্টি সে শুর। আর কি মিষ্টি তার কন্ঠ সর। আমি মিটিমিটি করে তাকিয়ে ওনাকে দেখছি আর ওনার কোরআন তেলাওয়াত শুনছি।
একটুপর কোরআন পড়া শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে উনি বললেন
-- চাঁদ উঠে ফ্রেশ হয়ে আসো দুজনে এক সাথে নামাজ পড়বো।
ওনার কথা শুনে আমার কি হলো জানিনা আমি বাদ্ধ মেয়ের মতো উঠে ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে চলে গেলাম। অথচ প্রতিদিন সকালে আমায় ঘুম থেকে নামাজের জন্যে ওঠাতে আম্মুকে রিতিমত যুদ্ধ করতে হতো।
ফ্রেশ হয়ে এসে দুজন এক সাথে নামাজ পড়ে নিলাম। নামাজ শেষে উনি আলমারি থেকে একটা আকাশি রঙের শাড়ি বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন
-- আজকে তোমার বিয়ের দ্বিতীয় দিন, তাই এই শাড়িটা পড়ে সুন্দর করে সেজেগুজে নিচে এসো। দাদিমা হয়তো এতক্ষণে উঠে পরেছেন।
কথাটা বলেই চলে যেতে নিলেন উনি। আমি ওনার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম
-- আমি তো শাড়ি পড়তেই পারিনা। এখন এটা আমি পড়বো কি ভাবে। ওনাকে বলতেও তো লজ্জা করছে।
হঠাৎই উনি আমার দিকে ঘুরে দাড়িয়ে বলে উঠলেন
-- আমি কুহেলিকে পাঠিয়ে দিচ্ছি ও তোমায় শাড়ি পড়তে সাহায্য করবে। তুমি চিন্তা করোনা।
কথাটা বলেই চলে গেলেন উনি। আমি হা করে ওনার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। উনি আমার মনে মনে বলা প্রতিটা কথা কি ভাবে যেনো বুঝে যাচ্ছেন। কিন্তু এটা কি করে সম্ভব।
চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,