একদিন আমি আমার ক'জন বান্ধবীর সাথে একটি রেস্টুরেন্টের কেবিনে অপেক্ষা করছিলাম অন্য এক মেয়ে বান্ধবীর জন্য। অবশ্য সেদিন তার জন্মদিন ছিল, আমরা খুব আনন্দ করছিলাম তখন। এমন সময় আমার বাবা ঐ রেস্টুরেন্টে ঢুকলেন এবং ওয়েটারের সাথে কথা বলতে লাগলেন।

 একদিন আমি আমার ক'জন বান্ধবীর সাথে একটি রেস্টুরেন্টের কেবিনে অপেক্ষা করছিলাম অন্য এক মেয়ে বান্ধবীর জন্য। অবশ্য সেদিন তার জন্মদিন ছিল, আমরা খুব আনন্দ করছিলাম তখন। এমন সময় আমার বাবা ঐ রেস্টুরেন্টে ঢুকলেন এবং ওয়েটারের সাথে কথা বলতে লাগলেন।



বাইরে থেকে কেবিনের ভেতরে দেখতে না পাওয়া গেলেও ভেতর থেকে বাইরে দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল। তাদের বাচনভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল বাবা কিছু জিজ্ঞেস করছেন এবং ওয়েটার জবাব দিচ্ছে। মুহুর্তের জন্য কিছুটা ভয় পেয়ে গেলেও পরক্ষণেই বাবা বেরিয়ে যাওয়ায় কিছুটা স্বস্তি ফিরে আসে মনে। আমি তখন বান্ধবীদের বসিয়ে রেখে ঐ ওয়েটারের দিকে এগিয়ে যাই এবং তাকে জিজ্ঞেস করি,


– “ এখনি যে ভদ্রলোক আপনার সাথে কথা বলে বেরিয়ে গেলেন তিনি এখানে কেন এসেছিলেন আর কী কথা বললেন আপনার সাথে আমি কি জানতে পারি? ”


বাবাকে 'ভদ্রলোক' বলায় ওয়েটারের যেন ওয়েটে লাগলো। সে তাচ্ছিল্যের হাসিতে জবাব দিলো,


– “ কীসের ভদ্রলোক উনি! আরে স্যার, এসব অশিক্ষিত আর ছোটলোক কোত্থেকে যে আসে কি বলবো আপনাকে। ”


ওয়েটারের এমন জবাবে আমার রক্ত যেন মাথায় উঠে গেলো। ইচ্ছে হচ্ছিল ওর গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিই। পারলে লাথি মারি। কিন্তু নিজেকে সামলে নিলাম। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,


– “ আগে তো আমাকে বলুন যে উনি কেন এখানে এসেছিলেন আর কী কথা বললেন আপনার সাথে। ”


এবার ওয়েটার বললো,

– “ এই লোক দুদিন পরপরই এখানে আসে। এসে জিজ্ঞেস করে কোন পদের মিষ্টির কেজি কত। কোনটার দাম কমেছে কিনা। এরপর এখানে সাজানো বাহারি সব মিষ্টি দেখে দেখে আবার চলে যায়। কিনে না একদিনও। অযথাই বিরক্ত করতে চলে আসে। ”


বিষয়টি কিছুটা আঁচ করতে পেরে বান্ধবীর দিতে যাওয়া ভোজন পার্টিতে অংশ না নিয়েই সেদিন আমি চলে আসি। এরপর কিছুদিন কেটে যায় আমি আমার বাবার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারিনি।


একদিন বন্ধুর জন্য জুতো কিনতে পরিচিত এক দোকানে যাই। কেনাকাটায় আমি পারদর্শী বলে বন্ধুদের কারোর কিছু কিনতে হলেই আমাকে সাথে নিয়ে যায়। বন্ধুর যখন একজোড়া জুতো পছন্দ হয় তখন দোকানির সাথে দরদাম শুরু করি। দামাদামির এক পর্যায়ে দোকানি একপ্রকার বাধ্য হয়েই মেমো বের করে তার কেনা দাম দেখায় এবং পঞ্চাশ টাকা মুনাফা দাবি করে। তখন ত্রিশ টাকা মুনাফায় আমি জুতোজোড়া নিয়ে নিই। এরপর যখন আমরা দোকান থেকে বেরুতে যাব তখন পেছন থেকে দোকানি ডেকে বললো,


– “ রিয়াদ ভাই, আপনার বাবা তো প্রায়ই জুতো কিনতে আসেন। না মানে, দরদাম করতে আসেন। এরপর যখন পছন্দের সাথে দামে পোষোয় না তখন চলে যান। নিজের বাবার সাথে যদি একদিন আসতেন আরকি..... ”


কথাগুলো বলে দোকানি তার সহকর্মীর দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসতে লাগলো। আমি একবার দোকানির দিকে আরেকবার আমার বন্ধুর দিকে তাকাই। ও আমার কাঁধে হাত রেখে ইশারায় বললো, ‘চলতো যাই।’


এরপর ঠিক করি আমি আমার বাবাকে অনুসরণ করবো। করিও তাই। বাবা মাছের বাজারে গিয়ে বড় বড় রুই-কাতলা আর বোয়াল, শোল যেদিকটায় বসে সেদিকটায় প্রথমে যান। ঘুরেন। দেখেন। দাম জিজ্ঞেস করেন। কিন্তু, কিনতে সাহস পাননা। এরপরও দাঁড়িয়ে থাকেন। চোখের সামনে পয়সাওয়ালাদেরকে সেসব মাছ কিনতে দেখেন। চোখদুটো তাঁর টলমল করতে থাকে। হয়তো মনে মনে আশা বাঁধেন, কিছু টাকা জমলেই সন্তানদের জন্য একদিন বাজারের সবচেয়ে বড় মাছটা কিনে নিয়ে আসবেন।


তরকারির বাজারে যান। মৌসুম নয় এমন সময়ে কিছুটা রং ধরেছে, কাঁচা, কিবা লাল টকটকে টমেটোর দর বেশ চড়া হয়। দেখেন। দাম জিজ্ঞেস করেন। কেনার সাহস পান না। তুলনামূলক সস্তা শাকসবজি নিয়ে বাড়ি ফেরেন। বাবা সবসময় ব্যাগ ভর্তি করে বাজার করেন। ব্যাগ ভরতে তিনি সবসময় কোন না কোন শাক কিনেই থাকেন। যাতে করে শাকসবজির জন্য হলেও ব্যাগটা ভরপুর মনে হয়।


আঠারো বছরের টগবগে এক যুবক আমি। পড়াশোনা, বন্ধুবান্ধব, আড্ডা, মাস্তি, ফোন, গেমিং, ঘুরাঘুরি এসবেই সময় কেটে যায়। সংসার কি করে চলছে, বাবা কি করে সবকিছুর যোগান দিচ্ছেন তা নিয়ে ভাববার সময় আমার কখনো ছিলোনা। কিন্তু, গেলো ক’দিনের কিছু ঘটনা আমাকে ভাবতে বাধ্য করে। সাধ্যের বাইরে থাকা রঙিন সকল স্বপ্নগুলোকে ছুঁড়ে ফেলে দিই আমি।


বাস্তবতা নিয়ে ভাবতে শুরু করি। কি করলে আমার বাবাকে মিষ্টির দোকানে গিয়ে আর খালি হাতে ফিরতে হবেনা তা নিয়ে ভাবি। ভাবি, কি করলে বাবা তাঁর পছন্দের বড় মাছটা কিনে এনে মাকে বলতে পারবেন, ‘আজ জমিয়ে রান্না করো তো! সবাই মিলে একসাথে মজা করে খাবো।’ ভাবি, কি করলে বাবা তাঁর পছন্দের জুতোজোড়া কিনতে গিয়ে আর খালি হাতে না ফেরেন।


এরপর নিজেকে বদলাই। জীবন যুদ্ধে নিজেকে নিয়োজিত করি। লড়াই করি। বারবার হেরে যেতে যেতেও পিছপা না হয়ে এগিয়ে যাই। অবশেষে জয়ী হই। জয়ী হতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। জয়ের পথটা মসৃণ ছিলোনা।


আজ আমার বয়স পঁচিশ আর বাবার প্রায় পঞ্চাশ। এখন বাবার পাঁয়ে মূল্যবান সব জুতোজোড়া শোভা পায়। বাজারে গেলে সবচেয়ে বড় মাছটা কিনে হাসিমুখে ফিরেন। ক'দিন পরপরই বাহারি সব মিষ্টি কিনে এনে সবাইকে নিয়ে খান। আমার বাবা আজ সুখী ও খুশি। হ্যা, আমি আর আপনি চাইলেই মধ্যবিত্ত সমাজের বাবাদের দিনগুলোকে বদলে দিতে পারি। তাঁদের দীর্ঘশ্বাসগুলোকে প্রাপ্তির হাসিতে পরিবর্তন করে দিতে পারি। তবে এজন্য আগে অবশ্যই এবং অবশ্যই আমাদের নিজেদেরকে বদলাতে হবে।


(সমাপ্ত)



Post a Comment (0)
Previous Post Next Post